বেদান্তদর্শন

বেদান্তদর্শন সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোচনা করা হল ।

বেদান্তদর্শন

বেদান্ত অর্থাৎ উপনিষদ বা বেদের জ্ঞানকান্ডের ভিত্তিতে ব্রহ্মসূত্র রচনা করে বাদরায়ন বেদান্ত দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সে কারণে একে জ্ঞান মীমাংসাও বলা হয়। পরবর্তীকালে ব্রহ্মসূত্রের উপর রচিত বিভিন্ন টীকাও এই দর্শনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে। এই সব টীকার মধ্যে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত ব‍্যাখ‍্যাই ভারতীয় জনজীবনে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রভাব বিস্তার করেছে এবং স্বামী বিবেকানন্দের মাধ্যমে সেই মতবাদ পাশ্চাত্য জগতেও প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বেদের একটি মন্ত্রে আছে-


“সহস্রশীর্ষা পুরূষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বা অত‍্যতিষ্ঠাদ্দশাঙ্গুলম্।।”


অর্থাৎ সহস্রশীর্ষাক্ষি পদসমন্বিত পুরুষ ব্রহ্মাণ্ডকে সর্বথা পরিব্যাপ্ত করেও অতিরিক্ত রইলেন।

উপনিষদে আছে-

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”-

অর্থাৎ এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সবকিছুই ব্রহ্ম। নামরূপযুক্ত সৃষ্টি জগৎপ্রপঞ্চ বস্তুতপক্ষে ব্রহ্মেরই প্রকাশ ও ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন।

শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম বা ইশ্বরই একমাত্র সত্য এবং তিনি অদ্বিতীয়া বা এক ও অধিকারী হলেও তা থেকে অপৃথক তার মায়া নামক শক্তির বলে তিনি বিবিধ বিচিত্র সৃষ্টি সম্পন্ন করেন। কিন্তু রজ্জুতে আমাদের যেরূপ আলোর স্বল্পতাবশতঃ সর্পভ্রম হয় সেরকম অজ্ঞান বা মায়াবশত আমাদের ব্রহ্মে জগতভ্রম হয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নানা সৃষ্টির বহুত্ব ও বিচিত্রতা সত্য নয়।বরং ভিন্ন জীব ও জগতের কেবল প্রাতিভাসিক সত্তা আছে, পারমার্থিক কোনো সত্তা নেই। রজ্জুতে সর্পের ন‍্যায় ব্রহ্মের বিবর্ত হল জীব ও জগত। অজ্ঞান বা অবিদ‍্যাবশতই আমরা জীব ও জগতকে ব্রম্ভ থেকে ভিন্ন দেখি। ব্রহ্মই আত্মা এবং তাকে সচ্চিদানন্দ বা সত‍্যস্বরূপ, জ্ঞান স্বরূপ ও আনন্দস্বরূপ বলে কিছুটা প্রকাশ করা যায়।

চেতনার নিম্নস্তরে জগত মানতে হয় এবং তখনই প্রাতিভাসিক বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকে সৃষ্টিগুণযুক্ত যা সগুন ব্রহ্ম বলতে হয় এবং জগতকে মায়া প্রসূত মিথ্যা বলে মনে করলে যে ঈশ্বর থাকেন তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম। অবিদ‍্যা সম্পূর্ণ দূরীভূত হলেই নির্গুণ ব্রহ্মের জ্ঞান হয় এবং সেই জ্ঞান লাভের জন্য ইন্দ্রিয় সংযম, বৈরাগ্য বা অনাসক্তি, জগতের অনিত্যতাবোধ ও মোক্ষের জন্য উদগ্র কামনার প্রয়োজন। নির্গুণ ব্রহ্মের জ্ঞান হলে আর জীব,জগৎ ও ব্রহ্মের মধ্যে কোন ভেদের অনুভূতি থাকে না এবং তখন সেই জ্ঞাতা “সোঅহং বা আমিই ব্রহ্ম এবং ‘তত্ত্বমসি’ বা তুমি বা অন্য সকলেও সেই ব্রহ্ম বলে উপলব্ধি করেন। অবশ্য রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রভৃতি আরও কিছু মতবাদ আছে।

Leave a Reply

%d bloggers like this: