রামায়ণের বিষয়বস্তু

রামায়ণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা হল । যদি কোন রামায়ণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তথ্য বাদ থাকে তা হলে নিচে লিখুন ।

রামায়ণের বিষয়বস্তু

প্রচেতার দশম পুত্র বাল্মীকি দীর্ঘদিন তপশ্চরণ করেন। সেই তপস্যার ফলশ্রুতিতে আদিকবি বাল্মীকি আপন মনের মাধুরী দিয়ে ‘নরচন্দ্রমা’ রামচন্দ্রের জীবনকাহিনি সপ্তকাণ্ড বিশিষ্ট রামায়ণে উপস্থাপিত করেছেন।

এই প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি স্মরণীয় ‘কবি তুব মনোভূমি রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।

রামায়ণের কাণ্ড

রামায়ণ সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত। কাণ্ডগুলি হল:

  • (১) আদি বা বালকাণ্ড,
  • (২) অযোধ্যাকাণ্ড,
  • (৩) অরণ্যকাণ্ড,
  • (৪) কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড,
  • (৫) সুন্দরকাণ্ড,
  • (৬) লঙ্কাকাণ্ড বা যুদ্ধকাণ্ড
  • (৭) উত্তরকাণ্ড।

রামায়ণের সংক্ষিপ্ত কাহিনি

রামায়ণের আদিকাণ্ড

(১) আদিকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে রামায়ণ রচনার ভূমিকা। ইক্ষ্বাকুবংশের রাজা দশরথের তিন রানির গর্ভে দেবতার কৃপায় চারটি পুত্র জন্মগ্রহণ করে। রাম, ভরত, লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন—এই চারজন পুত্রের বাল্যকালের বিশেষত রামচন্দ্রের বাল্যজীবনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বামিত্রের অনুরোধে যজ্ঞবিঘ্নকারী রাক্ষসনিধন, জনকের রাজসভায় হরধনুভঙ্গ ও সীতার সঙ্গে রামচন্দ্রের বিবাহ—এই কাণ্ডের বিষয়বস্তু। লক্ষ্মণের সঙ্গে জনকের অপর কন্যা ঊর্মিলার বিবাহ হল। ভরত ও শত্রুঘ্ন যথাক্রমে বিবাহ করলেন কুশধ্বজের কন্যা মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তিকে। পুত্র ও পুত্রবধূদের নিয়ে দশরথ অযোধ্যায় ফিরে এলেন।

রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ড

(২) অযোধ্যাকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে রামের অভিষেকের প্রস্তুতি, দশরথের দ্বিতীয়া পত্নী কৈকেয়ীর প্রার্থিত দুটি ধরে—রামের চোদ্দোবছর বনবাস ও ভরতের রাজ্যাভিষেক, রামের পিতৃসত্য পালনের জন্য লক্ষ্মণ ও সীতার সঙ্গে দণ্ডকারণ্যের পথে যাত্রা। পুত্রশোকে দশরথের মৃত্যু হল। চিত্রকূট পর্বতে ভরত রামকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিনতি জানালেও রামচন্দ্র দৃঢ় সংকল্পে অটল থাকেন। ভরত রামচন্দ্রের পাদুকা নিয়ে অযোধ্যায় ‘ফিরে সিংহাসনে জ্যেষ্ঠের পাদুকা স্থাপন করে রামের প্রতিনিধিরূপে রাজ্যশাসন করতে লাগলেন।

রামায়ণের অরণ্যকাণ্ড

(৩) অরণ্যকাণ্ডে দণ্ডকারণ্যের মুনিদের অনুরোধে রামচন্দ্রের অসংখ্য রাক্ষসবধের বৃত্তান্ত, লক্ষ্মণের দ্বারা রাবণের বোন শূর্পনখার নাসিকা ও কর্ণের ছেদন, রাবণের সীতাহরণ, রাম ও লক্ষ্মণের সীতাকে হারিয়ে শোক বিহ্বলতা, মুমূর্ষু জটায়ুর মুখে সীতাহরণের ঘটনা শ্রবণ ইত্যাদি বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড

(৪) কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে বিবৃত হয়েছে সুগ্রীবের সঙ্গে রামের মিত্রতা। সুগ্রীবের কথায় বানররাজ বালিকে রামচন্দ্র বধ করেন। তারপর হনুমানের সঙ্গে সীতার অনুসন্ধান এইকাণ্ডের বিষয়বস্তু।

রামায়ণের সুন্দরকাণ্ড

(৫) সুন্দরকাণ্ডের বিষয়বস্তু হল হনুমান কর্তৃক সমুদ্রলঙ্ঘন ও অশোকবনে সীতার সঙ্গে সাক্ষাৎকার, রামের দেওয়া আংটি দেখে সীতার কাতরতা, রাবণের কাছে রামের বীর্যবত্তার বর্ণনা ও সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়ার উপদেশ, রাবণের ক্রোধ ইত্যাদি। সুন্দরকাণ্ডে লঙ্কার আশ্চর্য সৌন্দর্যের অপূর্ব বর্ণনা আছে।

রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড বা যুদ্ধকাণ্ড

(৬) লঙ্কাকাণ্ড বা যুদ্ধকাণ্ডের বিষয়বস্তু হল বানরসেনারা সমুদ্রে সেতুবন্ধন করল। তারপর সুগ্রীবের সৈন্যসহ রামচন্দ্র সমুদ্রতীরে উপস্থিত হলেন। লঙ্কায় প্রবেশের পর রাবণের ভাই বিভীষণের সঙ্গে রামচন্দ্র মিত্রতা স্থাপন করলেন। রাক্ষসদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে সবংশে রাবণ নিহত হল। সীতাকে উদ্ধার করার পর সতীত্বের প্রমাণ দিতে সীতার অগ্নিপরীক্ষা, সীতা ও লক্ষ্মণসহ রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন, রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও রামায়ণপাঠের ফলশ্রুতি ইত্যাদি এই কাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে।

রামায়ণের উত্তরকাণ্ড

(৭) উত্তরকাণ্ডের প্রথম দিকে বিভিন্ন প্রাচীন গল্পকাহিনি বর্ণিত হয়েছে। রামচন্দ্র ও সীতার পরবর্তী জীবনের বর্ণনা বিশেষ নেই। সীতার চরিত্র বিষয়ে প্রজাদের সন্দেহের কথা রামচন্দ্র জানতে পেরে গর্ভবর্তী সীতাকে বাল্মীকির আশ্রমে রেখে আসার জন্য লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিলেন। এরপর সেখানেই সীতা নির্বাসিত হলেন। বাল্মীকির আশ্রমেই সীতার যমজপুত্র কুশ ও লবের জন্ম হয়। তারা মুনির শাস্ত্র ও শস্ত্র দুই বিষয়েই শিক্ষালাভ করে এবং বাল্মীকি তাদের রামায়ণ গান শিক্ষা দেন। স্বর্ণসীতা নির্মাণ করে রামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। সেই সভায় বাল্মীকি বুশ ও লবকে নিয়ে উপস্থিত হলেন এবং সর্বসমক্ষে কুশলব রামায়ণ গান শোনালেন। রামচন্দ্র যখন তাদের পরিচয় জানতে পারলেন তখন সীতাকে যদিও অযোধ্যায় আনলেন কিন্তু আবার অগ্নিপরীক্ষার কথায় সীতা ক্ষোভে, দুঃখে মাতা বসুমতীকে আহ্বান জানালেন এবং পৃথিবী দ্বিধাবিভক্ত হওয়ায় সীতা পাতালে প্রবেশ করলেন। শোকে বিহ্বল রামচন্দ্র তবুও নিজেকে সংযত করে আরও রাজ্যজয় করলেন, কিছু যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠানও সম্পন্ন করলেন। তারপর পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্রদের রাজ্যের বিভিন্ন অংশের শাসনভার দিয়ে মহাকালের নির্দেশে সরযূতীরে উপস্থিত হলেন এবং নদীতে অভিষেকক্রিয়া সম্পূর্ণ করে বিষ্ণুরূপে স্বধামে গমনকরলেন।

রামায়ণে মহর্ষি বাল্মীকি ভারতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কী আদর্শ হওয়া উচিত তারই চিত্র অঙ্কন করেছেন। রামায়ণের নানা চরিত্রগুলির বর্ণনায় বৈচিত্র্যময় ঘটনার সমাবেশে উজ্জ্বল রামকথা যুগ যুগ ধরে ভারতীয় জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে।

রামায়ণের বিভিন্ন পাঠ

মহাকবি বাল্মীকিই রামায়ণের মূল রচয়িতা। কিন্তু বিভিন্ন পাঠভেদে রামায়ণের বর্তমান যে রূপ পাওয়া যায় তার থেকে বাল্মীকির মূলরচনা আবিষ্কার করা কঠিন নয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য গবেষকরা বাল্মীকির মূলরচনা ও প্রক্ষিপ্ত অংশ নির্ধারণ করতে সযত্নে চেষ্টা করেছেন। রামায়ণের দুহাজারের বেশি হাতে লেখা পুঁথি পাওয়া গেছে। পাঠভেদ অনুসারে রামায়ণের পুঁথিগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় :

  • (১) গৌড়ীয় বা বঙ্গীয় পাঠ
  • (২) দক্ষিণী বা দক্ষিণ ভারতীয় পাঠ
  • (৩) পশ্চিমোত্তরীয় পাঠ।

Leave a Reply

%d bloggers like this: